শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৪৮ অপরাহ্ন

এই মাত্র পাওয়া

বিদ্যুতায়িত হয়ে পরিবারের সবার মৃত্যু : মাকে খুঁজছে শিশু

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট : শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
  • ২৩০ পঠিত

দিগন্ত ডেক্স : ছোট্ট শিশু হোসাইন। বয়স মাত্র সাত মাস। জন্মের পর শুধু মাকেই কাছে পেয়েছে ও চিনেছে। এর বাইরে তার বাবা ও বড় বোন। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ে ছিন্ন মায়ের বাঁধন। বদলে গেছে তার চেনা জগৎ। এখন সে কাউকেই চিনতে পারে না। হারিয়ে গেছে মায়ের গায়ের গন্ধ। যার কারণে কোনো কোলই তাকে স্বস্তি দিতে পারছে না। বারবার আতঙ্কে কেঁদে উঠছে শিশুটি। ঘুমিয়ে থাকা সময়টাতেই শুধু শান্ত থাকছে সে। ঘুম থেকে উঠে আবার চিৎকার করে কাঁদছে। চোখ দুটি খুঁজছে মায়ের মুখ। খুঁজছে আপনজনকে। কিন্তু তার অদৃষ্ট এমনই; আর কোনোদিন ফিরে পাবে না মা-বাবা ও বোনকে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মিরপুরে ঢাকা কমার্স কলেজ সড়কে সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার পাশে বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয়েছে শিশুটির মা-বাবা-বোনসহ চারজনের। তাঁরা হলেন– হোসাইনের বাবা মো. মিজান (৩০), মা মুক্তা বেগম (২৫) ও বোন সাত বছরের লিমা এবং অটোরিকশাচালক অনিক মিয়া (২১)। মিজানদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ দেন এই তরুণ। এর আগেই মা মুক্তার কোল থেকে ছিটকে পড়ে বেঁচে যায় শিশু হোসাইন। শিশুটি পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তখন তাকে উদ্ধার করেন তার মামা সাদ্দাম হোসেন আরিফ। শিশুটি এখন ঝিলপাড় বস্তিতে আমেনা বেগম নামে এক নারীর হেফাজতে রয়েছে। তাকে দেখতে ভিড় করছে উৎসুক জনতা।

একই পরিবারের তিনজন এবং অনিকের লাশ গতকাল শুক্রবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে তাদের লাশ নেওয়া হয় ঢাকা কমার্স কলেজ সড়কের ঝিলপাড় বস্তিতে। ওই বস্তিতেই বাস করতেন অনিক। তার বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার সাতগাঁও গ্রামে। এ ছাড়া মৃত মুক্তার মা-বাবাও বাস করেন একই বস্তিতে। গতকাল শুক্রবার রাতে অনিকের লাশ নিয়ে স্বজনরা রওনা হোন গ্রামের উদ্দেশে। অপরদিকে মিজান ও তার স্ত্রী-সন্তানের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির আগলপাশায়।

স্বজনরা জানান, মিরপুরে চিড়িয়াখানা রোডে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে একটি বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বাস করতেন মিজান। কখনও ফেরি করে লেবুর শরবত বিক্রি করতেন আবার কখনও বাসের হেলপারি করতেন তিনি। কিছুদিন আগে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মিজান গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় ফেরেন। দুপুরে ঝিলপাড় বস্তিতে শাশুড়ির বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দাওয়াত খেতে যান তিনি। রাত পৌনে ১০টার দিকে বৃষ্টি মাথায় চিড়িয়াখানা রোডের বাসায় ফেরার উদ্দেশে বের হন। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সড়কে জলাবদ্ধতা। সাত মাসের ছেলে হোসাইন ছিল মায়ের কোলে। আর সাত বছরের মেয়ে লিমা বাবার হাত ধরে পানির মধ্যে হাঁটছিল। তখনই তারা ফুটপাতের পানিতে বিদ্যুতায়িত হন।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ঝিলপাড় বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, মাতম বইছে। কাঁদছে সবাই। সন্তান, নাতনি ও মেয়ে জামাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মুক্তার মা কুলসুম বেগম। স্বজনরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, কার কাছে বিচার চাইব। কারে বলব। আল্লাহর কাছে বিচার ছেড়ে দিলাম। আমার সব শেষ হয়ে গেল। ছোট্ট নাতিটা এতিম হয়ে গেল।

হোসাইনের মামা সাদ্দাম হোসেন আরিফ দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২৫ গজ দূরের আমির স্টোর নামে একটি হার্ডওয়্যার দোকানের কর্মচারী। তিনি বলেন, আমার ভাগনেই যে পানিতে ভাসছিল তা আমি প্রথমে বুঝিনি। দেখি পানিতে একটা বাচ্চা হাবুডুবু খাচ্ছে। কোলে তুলে দেখি, আমারই ভাগনে। তখন তাকে দ্রুত একজনের কাছে দিই হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। ছোট্ট ভাগনেকে বাঁচাতে পারলেও দুলাভাই-বোন আর আরেক ভাগনিকে বাঁচাতে পারিনি।

পরে শিশুটিকে বস্তির এক বাসিন্দা আমেনা বেগম ও তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য বৃষ্টি দ্রুত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সুস্থ হওয়ায় গতকাল সকালে তাকে নিয়ে বাসায় ফেরেন আমেনা। তিনি বলেন, আল্লাহ শিশুকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। হোসাইনকে এখন আমার কাছেই রেখেছি। পুলিশও বলেছে রাখতে। পরে তাকে তার দাদা-নানার কাছে বুঝিয়ে দেব।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ও ডেসকোর হটলাইনে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়। তাদের অভিযোগ, ডেসকোকে ফোন করে ঘটনা জানিয়ে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করলেও অন্তত ২০ মিনিট পর বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছেছে হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের বিভিন্ন ভবনের দেয়াল কিংবা প্রাচীরের ওপর থেকে বিদ্যুতের তার ফুটপাতের নিচে চলে গেছে। স্থানীয় লোকজন জানান, সেগুলো অবৈধ বিদ্যুতের লাইন। গতকাল পুলিশ ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) জানিয়েছে, চোরাই বিদ্যুতের লাইন থেকে লিকেজ হয়ে পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়েছে। এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডেসকো। এ ছাড়া চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বলেন, ধারণা করা হচ্ছে চোরাই লাইনে লিকেজ থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিনিয়ত ওই বস্তি এলাকায় অবৈধ লাইনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। অনেক সময় তার কেটে দেওয়া হয়।

মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার থানায় মামলা হয়েছে। অবহেলাজনিত কাজের কারণে মৃত্যু হয়েছে– এমন অভিযোগ আনা হয়েছে এজাহারে। মৃত অনিকের বাবা বাবুল মিয়া এই মামলা করেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এক ক্লিকে বিভাগের খবর
© All rights reserved © 2023 digantabangla24.com