দিগন্ত ডেক্স : ডায়াবেটিসকে বর্তমানে একটি মহামারী রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খুব কম পরিবার আছে যেখানে অন্তত একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী নেই। কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ডায়াবেটিস কখনো পুরোপুরি নিরাময় হয় না। তবে নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
ডায়াবেটিস কী : ডায়াবেটিস, বাংলায় যাকে বলা হয় মধুমেহ বা বহুমূত্র; যা বিপাক ত্রুটিজনিত সমস্যা। এটি হচ্ছে এমন একটি রোগ যার কারণে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটে। ইনসুলিন নিঃসরণের পরিমাণ কমে গিয়ে একদিকে কোষে গ্লুকোজের ঘাটতি হয়, অন্যদিকে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সামগ্রিক অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে।
ডায়াবেটিসের নানা ধরন : সাধারণত চার ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে।
টাইপ-১ : টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে একেবারেই ইনসুলিন তৈরি হয় না। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ধরনের রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়।
টাইপ-২ : টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাধারণত ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের হয়ে থাকে। তবে ইদানীং ৩০ বছরের নিচেও এ ধরনের রোগী দেখা যাচ্ছে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ইনসুলিনের জন্য ইনজেকশনের ওপর নির্ভরশীল নয়। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস : অনেক সময় নারীদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আবার প্রসবের পর সাধারণত ডায়াবেটিস থাকে না। এ ধরনের জটিলতাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মা ও শিশু উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক।
অন্যান্য নির্দিষ্ট কারণভিত্তিক শ্রেণী : উপর্যুক্ত কারণগুলো ছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। যেমন—
জিনগত কারণে ইনসুলিন তৈরিতে ব্যাঘাত।
জিনগত কারণে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া।
অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ।
অন্যান্য হরমোনের আধিক্য, ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
কাদের ঝুঁকি বেশি : একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় যেকোনো সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি—
মা-বাবা, ভাই-বোন, রক্তসম্পর্কীয় বা নিকটাত্মীয় অর্থাৎ বংশে কারো ডায়াবেটিস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।
যাদের ওজন অত্যধিক বেশি।
যারা নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম বা শরীরচর্চা করে না।
বহুদিন ধরে স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে এমন ব্যক্তি।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল এবং ৯ পাউন্ডের অধিক ওজনের সন্তান প্রসব করেছে এমন নারী।
ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর ব্যক্তির শরীরে সাধারণত কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। এ লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সহজেই ডায়াবেটিস চিহ্নিত করা সম্ভব। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ—
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, বেশি পিপাসা পাওয়া, ঘন ঘন খিদে পাওয়া, অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া।
চোখে ঝাপসা দেখা, শরীরের কাটাছেঁড়া বা ক্ষত সহজে না সারা, পর্যাপ্ত খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া।
হাতে-পায়ে ব্যথা হওয়া ও অবশ হয়ে যাওয়া ও যৌন দুর্বলতা দেখা দেয়া।
আক্রান্ত হলে যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে : ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন স্ট্রোক, হৃদরোগ, পায়ের ক্ষত হতে পচন, চক্ষুরোগ, প্রস্রাবে প্রোটিন বের হওয়া, কিডনি রোগ, মাড়ির প্রদাহ। এগুলো ছাড়াও ডায়াবেটিসের কারণে যৌনক্ষমতা কমে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওজনের শিশুর জন্ম, অকালে সন্তান প্রসব, মৃত সন্তান জন্মদান বা শিশুর বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিস হলে করণীয় : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে শরীরের অন্য অঙ্গগুলোর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকে। তাই রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিরোধে মনোযোগ দিতে হবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রথমেই আক্রান্ত ব্যক্তির খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে।
প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট শরীরচর্চা করতে হবে।
ধূমপান, মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
প্রতিদিন অন্তত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।
মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকতে হবে।
ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় পরিহার করতে হবে।
নিয়মিত ওজন, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
যাদের ইনসুলিন নেয়া প্রয়োজন তারা ইনসুলিন নিতে অবহেলা করবেন না।
চিকিৎসকের সব পরামর্শ গুরুত্বসহকারে মেনে চলতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে।
লেখক: ডায়াবেটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞ, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।
Leave a Reply