দিগন্ত ডেক্স : ১৯২৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে অণিমা সিংহ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা অন্নদা প্রসন্ন দাস ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা আশালতা দাস একজন শিক্ষিত গৃহিনী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিপ্লবীর দুই ভাই ছিল ছোট বেলা থেকেই তার অনুপ্রেরণা। সিলেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। সেই সময় সামাজিক পরিবেশে মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করাটা খুব যে ভাল চোখে দেখা হত তা কিন্তু নয়। তারপরও রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য পারিবারিক বাধাকে অতিক্রম করেছিলেন মায়ের সহযোগিতায়। তার মা একজন প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন।
সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে নিযুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে অনিমা সিংহ মার্কসবাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং শ্রমজীবি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে সামিল করার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং তার সংকল্প ও দৃঢ় কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। কৃষকদের প্রতি তার সুগভীর মমতাবোধ থেকে তখন তিনি কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষক পরিবারে সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন এবং তাদের সাথে বাস করতে শুরু করেন। ততো দিনে ধর্মের ধজ্জা উড়িয়ে দেশভাগ হয়ে গেছে। বিদ্রোহী হাজং কৃষকরা তাদের গৌরব উজ্জ্বল টংক প্রথার বিরোদ্ধে লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় বারের মতন জোড় আন্দোলন শুরু করেছেন। সেই সময়টাতে নানান প্রতিকূলতা ও জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে অনিমা সিংহ কৃষক আন্দোলনের সাথে নিজেকে পুরোপুরি যুক্ত করেন। কৃষকদের সংগঠিত করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৫০ সাল জুড়ে চলছে দুর্বার কৃষক আন্দোলন। অণিমা সিংহও হাজংদের সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সশস্ত্র সংগ্রামেও যোগ দিচ্ছেন। দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতেও একে একে ছড়িয়ে পড়েছে কৃষক আন্দোলনের শ্লোগান। কৃষাণীরা দল বেঁধে লড়াইয়ে সামিল হচ্ছে। কৃষকের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অণিমা সিংহ দিনের বেলায় সঙ্গীদের সাথে পাহাড়ী এলাকাগুলোতে আত্মগোপন করে থাকতেন। সন্ধ্যা নেমে এলেই পাহাড়ী ঢাল থেকে নেমে গ্রামে গ্রামে মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে টংক প্রথার বিরোদ্ধে লড়াই অংশগ্রহণ করা জন্য উদ্ভূদ্ধ করতেন। প্রখরবুদ্ধিপ্ত অণিমা সিংহ কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে সারারাত ধরে ঘুরে বেড়াতেন।
আন্দোলনকে নসাৎ করার জন্য পুলিশ এ আন্দোলনের সংগঠক ও নেতাদের গ্রেফতার এবং বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করার জন্য গ্রামে ও পাহাড়ী এলাকায় নিচ্ছিদ্র পাহারা বসায়। এই সব পাহারা ও পুলিশী নির্যাতনকে উপেক্ষা করে আত্মগোপন অবস্থায় দিনের পর দিন অর্ধাহারে অনাহারে কাটিয়েও দৃঢ় চিত্ত অনিমা সিংহ তার কাজ চালিয়ে যেতেন। পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী কোন কোন সময় আন্দোলনরত পুরো এলাকা ঘিরে রাখতো। তখনও অনিমা সিংহ তার সঙ্গীদের সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে ভয় পেয়ে আন্দোলন বন্ধ না করে এবং আন্দোলনে আরো সক্রিয়ভাবে কৃষাণ-কৃষাণীরা যেন একত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে কাছে যেতেন। অনিমা সিংহ তার আদর্শ ও সংগ্রামের প্রতি অবিচল থেকে আরো দৃঢ়তার সাথে কৃষকাঞ্চল গুলোতে কৃষকদেরও সংগঠিত করে দুর্বার কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নিমগ্নভাবে নিজেকে সপে দিয়েছিলেন। আন্দোলন যতো বেগবান হচ্ছিল পুলিশের নির্যাতনও ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছিল ১৯৫০ সালেই আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার টংক প্রথা বাতিল করলেও আন্দোলনের সংগঠক নেতা কর্মীদের উপর চলতে থাকে চরম দমন পীড়ন ও অত্যাচার। তখন টংক এলাকায় থাকাটা হয়ে পড়ে একেবারেই অসম্ভব। অনিমা সিংহ এমন পরিস্থিতিতে পার্টির নির্দেশে চলে আসেন সিলেটে।
এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। কমরেড অনিমা সিংহের ভাই প্রিয়ব্রত দাস ১৯৫০ সালের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ হন। বাবা, মা, ভাই ও অন্যান্যদের দেশত্যাগ অনিমা সিংহকে প্রবল মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে। এই প্রতিকূল অবস্থাকে তিনি সাহসের সাথে মোকাবিলা করেন। এবং দেশ ছেড়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তারপর পার্টি নির্দেশে অনিমা সিংহ চলে আসেন ঢাকা। সেখানে আত্মগোপন থাকা অবস্থায়ই ১৯৫৫ সালে অনিমা সিংহ ও বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আত্মগোপন অবস্থায় নানান সমস্যা ও দুরবস্থার মধ্যেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ এবং ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ শতকের পাঁচ ও ছয় দশক এই দুই বিপ্লবী আত্মগোপন অবস্থাতেই কাটান। তাদের একমাত্র সন্তান দিবালোক সিংহ বড় হলে আত্মগোপন অবস্থায় থাকাটা খুবই সমস্যার হয়ে পড়লে তিনি ত্রিপুরায় চলে যান। মুক্তিযুদ্ধেও শুরু থেকেই তিনি আবারো সক্রিয়ভাবে কাজে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শরণার্থী শিবিরের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কৃষক সমিতির সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। জীবনে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে কাটালেও মার্কবাদের শিক্ষায় তিনি নিজেকে একজন সত্যিকারের বিপ্লবী চেতনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। যে কারণে বয়সের সীমারেখা তাকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে কখনোই দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। আমৃত্যু তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করা ও তাদের ন্যায্য অধিকারের লড়াই এবং শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য নিবিদিত ভাবে কাজ করে গেছেন।
১৯৭৩ সালে মস্কোতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের প্রবল বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় অণিমা সিংহ নিজের বাসায় রুটি বানাতেন এবং সেই রুটি বিতরণ করা হত। ১৯৮০ সালের জুন মাসে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারাক্তভাবে আহত হন এবং ১লা জুলাই এই বিপ্লবী মৃত্যু বরণ করেন। কৃষক আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা কমরেড অণিমা সিংহ লাল সালাম।
Leave a Reply