বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ অপরাহ্ন

এই মাত্র পাওয়া

পাচারের ১৭ লাখ কোটি ফেরাবে কে

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
  • ২২ পঠিত

দিগন্ত ডেক্স : পাচারে ফোকলা দেশের অর্থনীতি। প্রবাসীরা ঘামঝরা কষ্টের আয় দেশে পাঠান ঠিকই, কিন্তু সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চুরি ও লুটপাট করে দেশের টাকায় বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করেন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ লুটেরারা। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার বদলে এই পাচারকারীচক্র দেশ থেকে অন্তত ১৭ লাখ কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ওই টাকায় দুবাই, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে তারা বউ-বাচ্চা নিয়ে বিলাসবহুল ভিলাবাড়ি, ফ্ল্যাট কিনে আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন, অথচ তাদের লুটের শিকার অনেক ব্যাংক এখন দেউলিয়ার পথে।

ক্ষমতার পালাবদলে নতুন সরকার এলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে পাচারকারী রুই-কাতলরা। বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার করে সামিটের মতো গ্রুপ সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্য গড়ে তুললেও ওই টাকা ফিরিয়ে আনার অগ্রগতি এখনো চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ।

টাকা পাচারের ইস্যু যখন সরকারের অগ্রাধিকারে, তখনই নতুন করে দুবাইয়ে ৮৪৭টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়িসহ বিভিন্ন প্রপার্টি কেনার তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী একাই কিনেছেন ১৩৭টি ফ্ল্যাট।

ফরেন রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট তথ্যভাণ্ডার থেকে তৈরি একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, অর্থনৈতিকভাবে দেশ এখন ক্রান্তিকাল পার করছে। ঋণখেলাপি আর আর্থিক কেলেঙ্কারির মধ্যে ডলার সংকট থেকে তৈরি অর্থনৈতিক অস্থিরতার রেশ কাটছে না কোনোভাবেই। তবে নামে-বেনামে ব্যাংকের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করার ঘটনা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি।

দেশের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পাশাপাশি দুবাইও এখন বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ‘হাব’ হয়ে উঠছে। বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল এই শহরে টাকা পাচার করে প্রপার্টি কেনার একের পর এক তথ্য ফাঁস হচ্ছে।

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পর পাচারের টাকা ফেরানোর দাবি জোরালো হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী তার যে যোগাযোগ, সেটি কাজে লাগিয়ে তিনি চাইলে বিপুল অঙ্কের ওই পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে দেশ পুনর্গঠনের জন্য এই টাকা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

পাচারের টাকা ফেরানো সময়সাপেক্ষ হলেও তা সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদ-ব্যাংকাররা আশা প্রকাশ করেন।

তাদের ধারণা, আগের সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবে থাকা ব্যাংকগুলোর মদদেই মূলত টাকা পাচার হয়েছে। এ ছাড়া অনেক ব্যাংকের নজরদারির ঘাটতিও এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। তবে টাকা ফেরানো সময়সাপেক্ষ হলেও সরকার তা ফেরাতে ঠিক পথেই আছে। কোনো কোনো অর্থনীতি বিশ্লেষক মনে করেন, টাকা ফেরানো প্রায় অসম্ভব। যদি দ্বিপক্ষীয় উপায়ে সরকার টু সরকার চেষ্টা করে সফল হয়, তখন হয়তো কিছু টাকা ফেরত আসতে পারে।

তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, এরই মধ্যে ‘দুবাই আনলকড’ নামের অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) এবং নরওয়ের সংবাদমাধ্যম ই-টোয়েন্টিফোর পাচারের টাকায় প্রপার্টি কেনার তথ্য ফাঁস করেছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকায় আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবিসহ বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশিরা অন্তত এক লাখ প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। ইইউ ট্যাক্স অবজার্ভেটরির প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব অফশোর ওয়ার্ল্ড’ আরেক প্রতিবেদনেও বিশ্বের ‘ট্যাক্স হেভেন’ দেশগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার অফশোর সম্পদ রয়েছে বলে জানিয়েছে, যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১.৩ শতাংশ। এর মধ্যে অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এশিয়ার ট্যাক্স হেভেনে আর বাকিটা ইউরোপ-আমেরিকায়। এর আগে আইসিআইজে প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপার্সেও টাকা পাচারকারীদের তালিকায় অনেক বাংলাদেশির নাম এসেছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশ থেকে পাচারের টাকার পরিমাণ অন্তত ১৭ লাখ কোটি টাকা। টাকা পাচার নিয়ে অনেক আলোচনা, সরকারের অনেক উদ্যোগ ও তৎপরতার কথা জানা গেলেও এখনো তা চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এখনো পাচারকারীচক্র এবং তাদের হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি। সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে, টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও এখনো সাফল্য অধরাই রয়েছে।

জিএফআইয়ের তথ্য মতে, নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ থেকে গড়ে বছরে পৌনে এক লাখ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। পাচারকারীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী। তারা আমদানি-রপ্তানির আড়ালে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করছেন। ডিজিটাল কারেন্সির মাধ্যমেও এখন অর্থপাচার বাড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের কারণে বাংলাদেশের বছরে গড়ে প্রায় ২-৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। সরকার ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেন্টিং মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফিন্যান্সিং অব টেররিজম ২০১৯-২১’ শীর্ষক একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছিল। তাতে অর্থপাচারের গন্তব্য হিসেবে ১০টি দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইমান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে আরো কিছু দেশ রয়েছে। কৌশলপত্র তৈরিসহ পদক্ষেপও কম নেওয়া হয়নি। কিন্তু বিদেশ থেকে পাচারের টাকা ফেরানোর রেকর্ড খুবই নগণ্য।

দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের শত শত ফ্ল্যাট-ভিলাবাড়ি : দুবাইয়ের বিলাসবহুল অট্টালিকা বুর্জ খলিফা। টানা পাঁচ বছর ছয় হাজার ৮৩২ জন শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার এই ভবন নির্মাণ করেন। আর এই শ্রমিকদের চার হাজারই ছিলেন বাংলাদেশি। টানাটানির সংসারের এই প্রবাসী শ্রমিকরা বাড়িতে প্রিয়জন ফেলে রেখে তাদের ভাগ্যবদলের আশায় উত্তপ্ত মরুর দেশে গিয়ে রক্ত পানি করা খাটুনি দিয়ে বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল এই ভবন তৈরি করেন। তাদের ওই কষ্টের আয়ে তিল তিল করে জমানো টাকা রেমিট্যান্স হয়ে দেশে আসে। অথচ এই কষ্টার্জিত টাকাই নানা কৌশলে লুট করে নিয়ে গিয়ে ওই ভবনেই ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে আরাম-আয়েশ আর ভোগবিলাসে মত্ত আছে আরেক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ চক্র। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশের টাকা পাচার করে ওই চক্রটি শুধু বুর্জ খলিফাতেই কিনেছে ৭৭টি ফ্ল্যাট।

শুধু বুর্জ খলিফাই নয়, দুবাইয়ের এ রকম প্রধান প্রধান বিলাসবহুল এলাকা বিশেষ করে পাম জুমাইরাহ, মার্শা দুবাই, ওয়াদি আল সাফা, আল হাবিয়াহ, হাদেক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ, মদিনাত আল শিবা, জাবেল আলি, মেরকাদাতে এখন শত শত দামি ভিলাবাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, অফিসের মালিক বনে গেছেন বাংলাদেশিরা। এসব এলাকা শুধু বাংলাদেশিদের কাছে বিলাসবহুল নয়, সারা বিশ্বের ধনকুবেররাও সেখানে যান প্রপার্টি কিনতে। স্থানীয় সূত্র বলছে, এখন সেসব অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশি দুর্নীতিবাজদের পাচারের টাকায় কেনা প্রপার্টির ছড়াছড়ি। তারা দু-একটি নয়, ডজন ডজন প্রপার্টি কিনেছেন ওই সব জায়গার দুবাই মেরিটাইম সিটি, গ্রান্ডে, দ্য পলো রেসিডেন্স, রয়াল আটলান্টিস. দুবাই হিলস, রুকন, ওয়াদি, পাম জুমাইরাহ, বুর্জ খলিফাসহ নানা বিলাসবহুল ভবন ও কনডোমেনিয়ামে।

ব্যাংকের টাকা লোপাট, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে, কর ফাঁকি দিয়ে কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে এ রকম ৮৪৭টি ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক স্পেস কেনার তথ্য এসেছে কালের কণ্ঠের কাছে। ফরেন রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট তথ্যভাণ্ডার থেকে তৈরি ওই প্রতিবেদন এবং কালের কণ্ঠের অনুসন্ধান থেকে আরো জানা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে দুবাইয়ের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশি ১৩৪ জন ব্যক্তি মোট ৮৪৭টি ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যার দাম ন্যূনতম সাড়ে তিন কোটি থেকে শতকোটি টাকা পর্যন্ত।

তালিকায় অনেক পরিচিত মুখও রয়েছেন। এদের মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামেই কেনা হয়েছে ১৩৭টি ফ্ল্যাট ও হোটেল অ্যাপার্টমেন্ট। তিনি নাদ আল শিবা, পাম জুমাইরাহ, বুর্জ খলিফা ও দ্য পলো রেসিডেন্সে এসব ফ্ল্যাট ও হোটেল অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, পাম জুমাইরাতে তিন হাজার ৩৫৩ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বুর্জ খলিফায় ৯৮৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় ১১ কোটি টাকা। তিনি বেশির ভাগ ফ্ল্যাট কিনেছেন দ্য পলো রেসিডেন্সে। সেখানে ৯৩২ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় চার কোটি টাকা। যদি সবচেয়ে কম বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দামই হিসাব করা হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১৩৭টি ফ্ল্যাটের পেছনে তার খরচ করতে হয়েছে অন্তত ৫৫০ কোটি টাকা। সূত্র বলছে, শুধু এখানেই শেষ নয়; দুবাইয়ে তার আরো ফ্ল্যাট রয়েছে বলে খবর হয়েছে। এর বাইরেও তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে আরো ফ্ল্যাট ও বাড়ি কিনেছেন। তার শত শত ফ্ল্যাট-প্রপার্টি দেশ থেকে পাচার করে নেওয়া টাকায় কেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। চৌধুরী নাফিস সরাফতের নামে চারটি ফ্ল্যাটের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি দুটি কিনেছেন বুর্জ খলিফায় আর দুটি কিনেছেন গ্রান্ডে।

তথ্য পর্যালোচনা করে আরো জানা যায়, দুবাইয়ে ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ি ও অন্যান্য প্রপার্টি কেনার শীর্ষ দশের মধ্যে ১৩৭টি প্রপার্টি কেনায় প্রথম অবস্থানে রয়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন রুবাইয়া লস্কর। তিনি কিনেছেন ৩২টি প্রপার্টি। আশিকুর রহমান লস্কর ৩০টি প্রপার্টি কেনার মধ্য দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছেন। চতুর্থ অবস্থানে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি কিনেছেন ৩০টি প্রপার্টি। মো. ইদ্রিস শাকুর ২১টি প্রপার্টি কিনে তালিকার পঞ্চম অবস্থানে আছেন। মির্জা সামিয়া মাহমুদ ১৫টি প্রপার্টি কিনে তালিকার ষষ্ঠ অবস্থানে আছেন। দুবাইয়ের বিভিন্ন এলাকায় ১৫টি প্রপার্টি কিনে তালিকার সপ্তম অবস্থানে আছেন খালিদ হেকমত আল ওবাইদি। মনোজ কান্তি পাল কিনেছেন ১৪টি প্রপার্টি। তিনি আছেন তালিকার অষ্টম অবস্থানে। মোহাম্মদ শফিউল আলম ১৩টি প্রপার্টি কিনে তালিকার নবম স্থানে আছেন। কাজী মোহাম্মদ ওসমান ১২টি প্রপার্টি কিনে আছেন তালিকার দশম অবস্থানে।

দুবাইয়ের কোথায় কত ফ্ল্যাট-প্রপার্টি : পাচারের টাকায় কেনা ৮৪৭টি প্রপার্টির মধ্যে ফ্ল্যাট ৩৩৮টি, ভিলাবাড়ি ৭০টি, হোটেল অ্যাপার্টমেন্ট ৪৫টি, আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ২৪টি। এ ছাড়া অফিস, দোকান, বাণিজ্যিক প্রপার্টিসহ আরো অন্যান্য প্রপার্টি আছে ৩৫৭টি। এসব প্রপার্টির ৭৭টি বুর্জ খলিফায়, পাম জুমাইরায় ২৮টি, মার্শা দুবাইয়ে ১৪৫টি, ওয়াদি আল সাফায় ৯৬টি, আল হাবিয়াহ থার্ড এলাকায় ১৫টি, হাদেক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ এলাকায় ৩৩টি, মদিনাত আল মাতার এলাকায় ৩৪টি, নাদ আল শিবায় ১২৫টি, জাবেল আল ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় ২০টি, এমআইআরডিআইএফে দুটি, আল মেরকাদহে ছয়টি এবং অন্যান্য জায়গায় আরো ২৬০টি প্রপার্টি কেনা হয়েছে।

পাচারের টাকায় আরো যারা প্রপার্টি কিনেছেন : তালিকা পর্যালোচনা করে আরো জানা যায়, প্রত্যেকে ১২টি করে প্রপার্টি কেনার তালিকায় কাজী মোহাম্মদ ওসমান, মোহাম্মদ সালমান, মোকাররম হোসেন ওমর ফারুকের নাম রয়েছে। সৈয়দ রুহুল হকের নামে কেনা হয়েছে ১১টি প্রপার্টি। ১০টি করে প্রপার্টি কেনার তালিকায় গোলাম মোহাম্মদ ভুইয়া, মোহাম্মদ আবদুল মজিদ আলী ও মোহাম্মদ এমরান হোসেনের নাম রয়েছে।

নিজ নামে আটটি করে ফ্ল্যাট-প্রপার্টি কেনার তালিকায় নাম রয়েছে ১০ জনের। এরা হলেন ফারজানা চৌধুরী, ইয়ান উইলকক, খুরশিদা চৌধুরী, এম সাজ্জাদ আলম, মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ ইলিয়াস বজলুর রহমান, নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম আনু মিয়া, সামিরা আহমেদ ও তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।

নিজ নামে ছয়টি করে ফ্ল্যাট ও প্রপার্টি কেনার তালিকায় নাম আছে সাতজনের। তারা হলেন আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, হুমাইরা সালিমুল হক এশা, মোহাম্মদ শফি আবদুল্লাহ নবী, মোহাম্মদ ওয়ালিউর রহমান, নাহিদ কোরেশি, সালিমুল হক এশা, সামিনা সালমান ও সৈয়দ সালমান মাসুদ।

নিজ নামে চারটি করে ফ্ল্যাট ও প্রপার্টি কেনার তালিকায় নাম আছে ৩৭ জনের। তারা হলেন আহমেদ ইমরান চৌধুরী, আহমেদ ইফজাল চৌধুরী, আলহাজ মিজানুর রহমান, আনজুমান আরা শহিদ, আনোয়ারা বেগম, আজিজ আল মাহমুদ, আজিজ আল মাসুদ, বিলকিস ইকবাল দাদা, চৌধুরী হাসান মাহমুদ, দেওয়ান শাজেদুর রহমান, ফারহানা মুনেম, ফাতিমা বেগম কামাল, গুলজার আলম চৌধুরী, হাসান আশিক তৈমুর ইসলাম, হাসান রেজা মাহমুদুল ইসলাম, ইফতেখার রানা, জুরন চন্দ্র ভৌমিক, খালেদ মাহমুদ, এমডি আবদুস সালাম, এমডি আবুল কালাম আরশাদ আলী, এমডি ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, এমডি রাব্বি খান, এমডি সেলিম রেজা, মো. মিজানুর রহমান ভুইয়া, মোহাম্মদ আল রুমান খান, মোহাম্মদ মইন উদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ মিরাজ মাহমুদ, মোহাম্মদ নাজির আহমেদ, মোহাম্মদ মুশফিকুর রহমান, মশিউর রহমান ভুইয়া, মোস্তফা আমির, মোস্তফা জামাল নাসের, এস ইউ আহমেদ, সৈয়দ মাহমুদুল হক ও সৈয়দ সামিউল হক। এর বাইরে তিনটি, দুটি ও একটি করে ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়িসহ বিভিন্ন প্রপার্টি কেনার তালিকায় নাম রয়েছে আরো অনেকের।

কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরেও পাচারের টাকা : সামিট গ্রুপের মালিক মুহাম্মদ আজিজ খান এখন শুধু বাংলাদেশের ধনী হিসেবেই নন, তিনি এখন সিঙ্গাপুরেরও অন্যতম সেরা ধনী। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের তথ্য মতে, আজিজ খান ১.১২ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে সিঙ্গাপুরের ৪১তম শীর্ষ ধনীর তালিকায় নাম লেখান। অথচ এই টাকা তিনি বাংলাদেশ থেকে কোনো বৈধ উপায়ে নিয়েছেন বলে কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নেই। বরং এ পর্যন্ত দেশের ২০টি প্রতিষ্ঠানের ২৪টি ভেঞ্চারকে সর্বসাকল্যে ৬৯.৫ মিলিয়ন বা প্রায় সাত কোটি ডলার বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাহলে এত বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি কিভাবে সিঙ্গাপুরে নিয়ে শীর্ষ ধনী হলেন, এখন এই প্রশ্ন উঠেছে।

আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুস সোবহান গোলাপের নিউইয়র্কে ৯টি বাড়ি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বেলজিয়ামে বাড়িসহ বিভিন্ন সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে। সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর নামে কানাডার টরন্টোর স্কারবোরোতে বাড়ি, সোনালী ব্যাংকের আলোচিত ঋণখেলাপি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হান্নান রতনের কানাডায় তিনটি বাড়ি, সাদ মুসা গ্রুপের মুহাম্মদ মোহসিনের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়িসহ সম্পদের তথ্য বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। এ ছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদসহ অনেকের বিদেশে সম্পদ থাকার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে।

ক্যাসিনোকাণ্ড ফাঁসের পর বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার পাঁচ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পাচারের বিষয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কাছে আইনি সহায়তা চেয়েও সাড়া মেলেনি। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের পরিচালক সেলিম প্রধানের ১২ কোটি টাকা, অস্ট্রেলিয়ায় বিসিবির পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার চার কোটি ৩৪ লাখ টাকা, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের তিন কোটি টাকা এবং মমিনুল হক সাঈদের চার কোটি ৪৭ লাখ টাকা পাচারের বিষয়ে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কাছে আইনি সহায়তা চাওয়া হয়। এসব সহায়তায়ও সাড়া মেলেনি বলে জানা গেছে।

ব্যাংকার, বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা কী বলছেন? : টাকা পাচারের কারণ এবং তা ফেরানোর বিষয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি ও বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ফারুক মঈনুদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টাকা পাচারের একটা বড় কারণ হলো ব্যাংকের কমপ্লায়েন্ট না হওয়া। যেসব ব্যাংক কমপ্লায়েন্ট, তাদের মাধ্যমে পাচার হওয়া কঠিন। কমপ্লায়েন্ট ব্যাংকগুলো আমদানির ক্ষেত্রে যেসব সংবেদনশীল সফটওয়্যার ব্যবহার করে, তাতে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং কঠোরভাবে নজরদারি করা হয়। যেসব ব্যাংক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সহায়তা করেছে, ওই সব ব্যাংকের মাধ্যমেই পাচারটা বেশি হয়েছে বলে মনে হয়। আর পাচারের টাকা ফেরাতে আইনি পদক্ষেপ তো নিতেই হবে। তার পাশাপাশি ব্যক্তি ও কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ বাড়িয়ে করা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকের সঙ্গেই বহির্বিশ্বে ভালো যোগাযোগ রয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে টাকা ফেরানো যেতে পারে।’

বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টাকা পাচার হয়েছে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত টাকাটা পাচার হয়েছে যে ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাববলয়ে ছিল, তাদের মাধ্যমে। ওই সব ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা মেরে দিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গত ১০ বছরে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ও কেনাকাটায় দুর্নীতির বিষয়টি। শুধু মেগাপ্রকল্পেই নয়, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে ১০০ বা ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পেও। এই টাকাগুলোই মূলত পাচার হয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েই এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। টাকা কবে ফেরত আসবে, সেটা পরের কথা। তবে তারা এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, আমি মনে করি, তা ঠিক পথেই আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে একটা ভালো তদারকি দেখা যাচ্ছে। বিদেশি সহযোগী ও সরকারের সঙ্গেও কথা বলছে। তবে টাকা কবে ফেরত আসবে, এটা এখনই বলা মুশকিল।’ সুত্র : কালের কন্ঠ

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এক ক্লিকে বিভাগের খবর
© All rights reserved © 2023 digantabangla24.com