মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৪ অপরাহ্ন

এই মাত্র পাওয়া

হাওর ও সমতলে পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষায় নার্সারি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট : বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১৫২ পঠিত

সুমন তালুকদার, নেত্রকোনা থেকে : বিদেশী আগ্রাসী প্রজাতি নয় দেশীয় প্রজাতিই বাঁচাবে বাংলাদেশ। এই শ্লোগানকে সামনে রেখে নেত্রকোনার হাওর ও সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকায় উদ্যোগী কৃষকের চিন্তা ও পরিশ্রমের ফলে প্রতিবেশ পরিবেশ রক্ষা পাচ্ছে। দিন দিন বিদেশী আগ্রাসী প্রজাতি আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশকে হুমকিতে ফেলে দিচেছ। হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রজাতির গাছ, লতাপাতা, প্রাণীসম্পদ। নার্সারিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হচেছ বিদেশী প্রজাতি। শত বাধাবিপত্তির মাঝেও নেত্রকোনা অঞ্চলে নার্সারি তৈরী করে দেশী বিলুপ্ত বিরল গাছের চারা উৎপাদন ও সম্প্রসারণ করে যাচ্ছেন উদ্যোগী কিছু নারী-পুরুষ।

আধুনিক কৃষি ও উন্নয়নের নামে আমাদের দেশের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। কৃষির উন্নয়নের নামে অধিক ফলনের আশায় কৃষকরা হাইব্রীড ফসল চাষ করছে। হাইব্রীড ফসল চাষে ব্যবহার করছে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হরমোন, আগাছানাশক এবং জমিতে অনেক সেচের প্রয়োজন হচ্ছে। বিগত প্রায় এক দশক ধরে মূনাফা লোভি ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে কৃষি জমির মাটি কেটে ফিসারী, গাছপালা কেটে শিল্প কারখানা ও হাট-বাজার তৈরীর ফলে দেশের জলাশয়, কৃষি জমি ও গাছপালা দিন দিন সংস্কুচিত হয়ে পড়ছে। বিদেশী ও আগ্রসী প্রজাতি আমাদের পরিবেশ প্রকৃতিকে আজ আমাদের দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ হুমকীর সম্মূখীন।

হাওরে উঁচু জমি না থাকায় হাওরাঞ্চলে গাছপালার সংখ্যা ও গাছপালার বৈচিত্র্য অতি সামান্য। হাওরের যেসব সামান্য উঁচু জমি ও বসতভিটার সামান্য পরিমান জমিতে বর্ষা মৌসুমে ৩-৪ ফুট পানি থাকে এবং ৫-৬ ফুট লম্বা পানি সহনশীল গাছের চারা রোপন করা যায়, সেসব জমিতে হাওরবাসীরা ইচ্ছা থাকলেও চারার অভাবে গাছ রোপন করতে পারে না।

বারসিক মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কৃষি, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন ধরণে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। হাওরে বারসিক বাস্তবায়িত কার্যক্রমগুলোর মধ্যে হাওর উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনে কৃষক নেতৃত্বে ধানের প্রায়োগিক গবেষণা। হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধানের বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণে হাওর এলাকা উপযোগি কৃষক নেতৃত্বে হাওর এলাকা উপযোগি শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে কৃষক নেতৃত্বে শস্য ফসলের প্রায়োগিক গবেষণা। হাওরের কৃষকদেরকে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষে উদ্বুদ্ধকরণে বিনামূল্যে হাওর এলাকা উপযোগি বৈচিত্র্যময় সবজি ও শস্য ফসলের বীজ সহযোগিতা প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ, সংলাপ, মতবিনিময় ও ইস্যুভিত্তিক গ্রামসভা ও প্রচারণার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও হাওর এলাকায় জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কেঁচো কম্পোষ্ট উৎপাদনে কৃষকদের উপকরণ সহায়তা এবং হাওরের পরিবেশ উন্নয়নে যুব, শিক্ষার্থী ও কৃষকদের গৃহীত উদ্যোগ বাস্তবায়নে উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের স্থানীয় যুব জনগোষ্ঠী ও জনসংগঠন বারসিক’র সহযোগিতায় হাওরের পরিবেশ উন্নয়নে বিগত বছর থেকে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ, ইউনিয়ন পরিষদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাওরের রাস্তা, গুচ্ছগ্রাম ও বসতভিটায় এলাকা উপযোগি বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু পানি সহনশীল গাছের চারা (হিজল, করচ, বরুন, তমাল) এলাকায় সহজলভ্য না হওয়ায় বনায়ন করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মূখীন হতে হয়েছে।
বারসিক হাওরের জনগোষ্ঠীর জন্য হাওর এলাকা উপযোগি (পানি সহনশীল) গাছের চারা সহজলভ্যকরণে হাওরাঞ্চলে নাসার্রী স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মদন ইউনিয়নের কুলিয়াটি গ্রামে একজন নারী উদ্যোক্তা কৃষাণী জেসমিন আক্তারকে নাসার্রীর উপকরণ (ছিদ্রযুক্ত বিভিন্ন আকারের পলি ব্যাগ, ঝাঁঝড়ি, নেট জাল, জিআই তার, পলিথিন শীট, বাঁশসহ বৈচিত্র্যময় কাঠ, ঔষধী, ফলদ, ফুল ও সবজি বীজ) সহায়তা প্রদান করা হয়। গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের একজন কৃষককে আরও একটি হাওর নাসার্রী স্থাপনের জন্য উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়। ২০২০ সালের প্রথম দিকে মদন ইউনিয়নের হাওর ঘেষা উচিতপুর গ্রামের কৃষক আরব আলী তালুকদারকে তার আগ্রহের ভিত্তিতে নাসার্রী স্থাপনের জন্য উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়। উপকরণ সহায়তা পেয়ে কৃষক আরব আলী ও জেসমিন আক্তার বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি, ফল ও পানি সহনশীল গাছের চারা উৎপাদন আরম্ভ করেন। ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে হাওর এলাকা উপযোগি বৈচিত্র্যময় সবজি ও ফলের চারা উৎপাদনে আরও একটি নার্সারী স্থাপনের জন্য গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের শান্তিপাড়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক ইদু মিয়াকে নাসার্রীর উপকরণ (পলিব্যাগ, পলিথিন শীট, ঝাঁঝড়ি, পেঁপে, মরিচ, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, বেগুন, চালকুমড়া, শসা, মিষ্টিকুমড়াসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি বীজ) সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

কুলিয়াটি গ্রামের জেসমিন আক্তার বিগত দুই বছরে তার নাসার্রী থেকে প্রতিবেদনকালীন সময় (১৮ মার্চ, ২০২১) পর্যন্ত ১,২০,০০০/- (এক লক্ষ বার হাজার টাকা) চারা বিক্রি করেছেন এবং প্রায় ১২০০টি চারা (পেঁপে, সুপারী, পেয়ারা ও সবজি চারা) গ্রামের জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। বর্তমানে তার নার্সারীতে বিক্রির পর সুপারী, হিজল, করচ, পেঁপে, পেয়ারা, কৃষ্ণচুড়া, মরিচ, জলপাই, নিম, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়াসহ ১১ জাতের প্রায় ৭৩০০টি গাছের চারা রয়েছে। গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রামে পানি সহনশীল গাছের বনায়নের জন্য তিনি যুব সংগঠনকে ১০০টি হিজল ও করচ গাছের চারা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

আরব আলী তালুকদার তার নাসার্রীতে বিগত এক বছরে দশ ধরণের (আম, হিজল, করচ, নিম, পেয়ারা, আমরা, জলপাই, মরিচ, বেগুন, পেঁপে) প্রায় ১৩৬০০ হাজার চারা উৎপাদন করেছেন। এর মধ্যে হিজল ও করচের চারা ৭৫০০, নিম ১৫০০, পেয়ারা ১৫০০, বেগুন ৮০০, মরিচ ৫০০, আম ৫০, জলপাই ৯০০, আমড়া ২০, করমচা ২০, পেঁপে ২০০টি। ২০০টি পেঁপের চারা, হিজলের ৬,০০০ হাজার চারা, অন্যান্য ফলজ, ঔষধি, বনজ চারা মিলে মোট ২,১০,০০০/- টাকায় বিক্রি করেছেন। চারা উৎপাদনের মত উচুঁ জমি না থাকায় এবং বসতভিটা খুবই ছোট হওয়ায় কৃষক আরব আলী বাঁশের দোতলা মাঁচা তৈরী করে তাতে মরিচ, বেগুন ও পেঁপে চারা উৎপাদন করেছেন।

হাওর অধ্যুষিত গোবিন্দশ্রী ইউনয়নের শান্তিপাড়া গ্রামের কৃষক ও সবজি নার্সারী উদ্যোক্তা ইদু মিয়া নাসারী উপকরণ সহায়তা পেয়ে গ্রীষ্মকালীন সবজি ও ফলের চারা (পেঁপে) উৎপাদন শুরু করেছেন। বর্তমানে তিনি নাসার্রীতে উন্নত জাতের পেঁপে, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, শসা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা এবং বারমাসি মরিচ ও বেগুনের রোপন করেছেন। পরবর্তীতে (বীজ সংগ্রহের সময় হলে) তিনি পানি সহনশীল গাছের চারা এবং লেবুসহ বৈচিত্র্যময় ফলের চারাও উৎপাদন করবেন বলে জানান ইদু মিয়া। আমাদের এই বৃক্ষপ্রেমিক মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা জানাই যে নার্সারি তৈরী করে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা রক্ষার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন হাওর, পাহাড় ও সমতলে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এক ক্লিকে বিভাগের খবর
© All rights reserved © 2023 digantabangla24.com