গুঞ্জন রেমা, কলমাকান্দা থেকে : “গ্রামীণ নারীরা বিশ্বব্যাপী জীবন যাত্রার ব্যয় সংকটের মুখোমুখী” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের তারানগর গ্রামে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গ্রামীন নারী দিবস। রোববার নানা আয়োজনে এ দিবস পালিত হয়।
এ উপলক্ষ্যে বীজ মেলা ও সর্বস্তরের অংশগ্রহনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শর্তবর্ষী প্রবীণ ব্যক্তিত্ব লেবিংসন নকরেক এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা মি. বদিন জাম্বিল।
গ্রামীণ নারীদের বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি এবং কৃষি, খাদ্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ উন্নয়নে গ্রামীণ নারীরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তা উদযাপন করার জন্য ২০০৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালন করা হয়ে আসছে আজ অবধি।
গ্রামীণ নারীরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরাসরি খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখছেন যা অস্বীকার্য। খাদ্য উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো বীজ, যা নারীরা অতি যতেœর সহিত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে আসছেন আদিকাল থেকে। বারসিক বহু দিন ধরে কৃষকদের এ উদ্যোগটি স্বাগত জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি বীজ সংরক্ষণ করার যে প্রথা ও পদ্ধতি তা বিস্তার করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ে। এরই অংশ হিসেবে গ্রামীণ নারী দিবস উপলক্ষ্যে এই বীজ মেলার আয়োজন করা হয়।
বীজ মেলায় ১৮ জন কৃষাণী তাদের সংরক্ষণকৃত বীজ গুলো প্রদর্শন করার জন্য মেলায় নিয়ে আসেন। সর্বোচ্চ বীজ সংরক্ষনকারী তেনিফা রংদী তিনি মোট ৩৩টি বৈচিত্র্যময় সব্জি বীজ প্রদর্শন করেন। মেলায় ৭ জন কৃষানীর মাঝে ১২ জাতের সব্জি বীজ বিনিময় হয়েছে।
আলোচনা সভায় মোছা: জোস্না আক্তার বলেন, আমরা নিজেরা যাদি বীজ রাখি তবে আগাম বীজ রোপন করতে পারি এতে করে ফলন আগাম পাবো এবং ভালো দামে বিক্রি করতে পারি। যার জন্য আমি নিজে বীজ রাখি এবং অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করি।
প্রধান অতিথি বীরমুক্তি যোদ্ধা বদিন জাম্বিল বলেন, ‘‘উঠান ভরা লাউ শসা, খনা বলে লক্ষীর দশা, গ্রামীন নারীরা বাড়ীর অঙ্গিনায় যেসব শাকসব্জি উৎপাদন করে সবার জন্য খাদ্য উৎপাদন করেন তাদের প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শন করা উচিৎ, আমি নিজেও আমার বাড়ীর আঙ্গিনায় শাকসব্জি উৎপাদন সহ বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করি। নিজের হাতের বীজের মত অন্য বীজ হয় না। গ্রামীন নারী দিবসে যারা এখানে এসেছেন তারা প্রত্যেকে বীজ রাখেন, যদি আমরা নিজেদেরকে কৃষক বলে দাবি করি তাহলে বীজ রাখার সংস্কৃতি বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া নারীর ক্ষতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এমন আরো উদ্যোগ গ্রহন করার জন্য বারসিক কে আহবান জানান।
উল্লোখ্য: জনগোষ্ঠীকে বীজ সংরক্ষণ আরো গতিশীল ও উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বারসিক এর সহযোগিতায় এবং মিকরাকা নারী সংগঠনের উদ্যোগে তারানগর গ্রামে ২০২২ সালে স্থাপন করা হয় কমিউনিটি বীজ ব্যাংক। কমিউনিটি বীজ ব্যাংকে বর্তমানে ২৫ জাতের ধান বীজ সংরক্ষণ করা আছে। যেমন- ডিএস-৩, লোহাজং, সোনারী পাইজাম, রহমত, খেকশিয়াল, আতব, কার্তিক শাইল, সাগর ফণা, রাধুনী পাগল, বাদশা ভোগ, জেসমিন, কাতারী ভোগ, রতিশাইল, গন্ধরাজ, তুলসীমালা, চিনিগুড়া, চিনিশাইল, মালশিরা, গুটিস্বর্ণা, মালতী বিন্নি, কার্তিক বিন্নি, গেংগেং বিন্নি, আগুইন্যা বিন্নি, মশুরী, ব্রিডিং (মথি ঘাগ্রা এর ব্রিডিং করা ধান)।
সব্জি বীজের মধ্যে রয়েছে পুইশাক, কলমিশাক, শসা, ধুন্দল, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পাটশাক, টমেটো, ডাটাশাক, লালশাক, ডিম বেগুন, শিংনাথ বেগুন, চুখাই, চিক কাইক্যা শিম, সাদা কাইক্যা শিম, আশ্বিনা শিম, খায়রুন সুন্দরী শিম, পুডি শিম, সাদা পুডি শিম, আমপাতা শিম, কাতলা ও কতিউড়ি শিমের বীজ, ৫ জাতের মরিচ বীজ ইত্যাদি।
তারানগর কমিউনিটি বীজ ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত ৭টি গ্রামে ৯৭টি পরিবারকে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন জাতের শাসসব্জি ও ধানের বীজ সহযোগিতা করা হয়েছে। যেসব গ্রামের মানুষেরা এ বীজঘর থেকে বীজ সহযোগিতা পেয়েছেন সেই গ্রামগুলো হলো: তারানগর, শিবপুর, গৌরিপুর, লেংগুরা, ফুলবাড়ী, কালাপানি, গোড়াগাও প্রভৃতি। এ বছর আমন মৌসুমে ১১ জন কৃষকের মাঝে ১০টি জাতের ধানের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। যেমন – গন্ধরাজ, চিনিশাইল, মালশিরা, রহমত, মালতী বিন্নি, সাগরফণা, খেকশিয়াল, পুরা বিন্নি, রতিশাইল, চিনিগুড়া।
Leave a Reply