নব্বইয়ের দশকের প্রাণবন্ত কিশোর সমাজের ইতি ঘটেছে বহু আগেই। খেলার মাঠের উপচে পরা তরুণদের আগমনেরও যুগ কেটে গেছে। মাঠ নেই! মাঠ নেই বলে হাহাকার যতই হোক কয়টা মাঠে এখনো কিশোরসমাজ খেলতে আসে প্রশ্নটা অবশ্যই তুলে রাখা যায় না। সকাল-সন্ধ্যা স্কুল, টিউশনের কষাঘাতে জর্জরিত ভবিষ্যৎ কান্ডারিদের হাতে প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার তাদের মানসিকতায় কতটা প্রভাব ফেলছে চারপাশে চোখ বুলালেই ভুরিভুরি উদাহরণ পাওয়া যায়।
কিশোরদের হাতে হাতে মুঠোফোন এবং অনেকের মুঠোফোনেই উপস্থিত বিভিন্ন বেটিং সাইট। কিশোর বয়স থেকেই জুয়া খেলার নেশা যদি কাউকে পেয়ে বসে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অবশ্যই তার পরিবার এবং সমাজের চিন্তা করা উচিত। আইপিএল, বিপিএল, সিপিএল, ইউরোপের ফুটবল লীগ এমন কোনো খেলা নেই সেখানে বাজি ধরা যায় না। কিশোরদের বিভিন্ন লোভনীয় অংকের প্রস্তাব দিয়ে সেখানে বাজি ধরতে উদ্ধুদ্ধ করে বেটিং সাইটের পরিচালকেরা। শুরুতে হয়তো ভালো টাকা লাভ করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে সেখানে অনেককেই সর্বশান্ত হচ্ছে। ফলাফল অর্থনৈতিক ক্ষতি, জুয়ার টাকা জোগাড় করতে চুরি, ছিনিতাই সহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়া।
এই জুয়া যখন নেশায় পরিণত হয় তখন সেটা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তাদের মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। পড়াশোনার ফলাফল খারাপ হয় এবং সামাজিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখান থেকে জড়িয়ে পড়ে মাদকে।বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই এখন মাদক জোগাড় করা যায়। অনেক মাদক বিক্রেতাই ঝুঁকি এড়াতে মাদক বিক্রি করে ফেসবুকেই। এক্ষেত্রে তারা একটি নকল অ্যাকাউন্ট অথবা পেজ খুলে এই অপকর্ম চালিয়ে যায়, যা কিনা কোনো পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে মাদক বিক্রয়ের চেয়ে অধিক নিরাপদ। প্রযুক্তি শুধু জুয়াকেই তাদের কাছে সহজলভ্য করেনি, মাদককেও এনে দিয়েছে হাতের নাগালে।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় আরো একটা ভয়াল ছোবল পর্নোগ্রাফি। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফির আসক্ত। সরকারের পক্ষ থেকে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে। প্রায় বিশ হাজারের অধিক পর্নোসাইট বন্ধ করেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না এই ভয়াল ব্যাধি। মার্কিন এক মনোবিজ্ঞানী জেফরি সেটিনোভারের মতে, পর্নোগ্রাফি আসক্তি হেরোইনের আসক্তির চেয়েও ভয়ংকর। এই আসক্তি আমাদের কিশোরসমাজে কী ভয়ানক প্রভাব ফেলছে সেটা আমাদের চিন্তারও বাইরে।,
এই তিনের বাইরেও প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলমান। প্রযুক্তি আমাদের বেকারত্ব বাড়াচ্ছে। দৈনিক ছয় থেকে আট ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব উপস্থিতি কিশোর এবং তরুণ সমাজের জীবনের উর্বর সময় নষ্ট করছে। অথচ এই সময়েরই সদ্ব্যবহার করে বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপ করা যায়। ভবিষ্যতে আমাদের চাকরির বাজারে লড়তে হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। অর্থাৎ জীবন থেকে বেকারত্ব নামক অভিশাপ দূর করতে আমাদের হতে হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চেয়েও দক্ষ। অথচ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় আমরা নষ্ট করছি লাইক, রিয়েক্ট, শেয়ারিংয়ে।,
স্মার্ট বাংলাদেশ আমাদের এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহারে যেখানে নাগরিক, অর্থনীতি, সরকার সবই হবে স্মার্ট এবং বিশ্বমানের। পাশাপাশি আমাদের ভাবতে হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রযুক্তির এই অবাধ ব্যবহারের কুফল এবং আমাদের কিশোর, তরুণ সমাজ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়েও। কাউন্সেলিং, বিভিন্ন সভা, সেমিনার করা যেতে পারে আমাদের তরুণদের সতর্ক করার জন্য। কীভাবে একটি প্রোডাক্টিভ তরুণ সমাজ গড়ে তোলা যায় এ নিয়ে পরিকল্পনার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধের প্রথম শিক্ষা আসতে পারে পরিবার থেকেই। এক্ষেত্রে স্মার্ট প্যারেন্টিং রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, তরুণদের হাতেই স্মার্ট বাংলাদেশের পতাকা এবং এর কারিগরও তরুণেরাই।,
লেখক: জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগ, প্রথম বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।,
Leave a Reply