সিলেট ব্যুরো : একাওরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা প্রশান্ত সরকার (৭৬) বিএ এখন হাসপাতালে পড়ে আছেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
তিনি মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের সুনামগঞ্জ মহকুমার তাহিরপুর থানার টেকেরঘাট সাব সেক্টরের একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৪৩ সালের ২০ আগষ্ট দিনাজপুরের হাকিমপুর থানার হিলি মিশন গ্রামের প্রয়াত প্রমোদ সরকার ও লতিকা সরকার দম্পতির ছেলে প্রশান্ত সরকার বাঙালী খ্রীষ্টান পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। একাওরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে টেকেরঘাট সাব সেক্টরে ওয়ারল্যাস কমিউনিকেশন কোডিং ও ডিকোডিং’র কাজে তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন।
বুধবার বিকেলে এ প্রতিবেদকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া খ্রীষ্ট্রান মিশনারী হাসপাতালে থাকা বাকরুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর শয্যাপাশে থেকে ৬৫ বছর বয়সী স্ত্রী শালীবতী রেমা বলেন, আমার স্বামী তখনো বিয়েই করেননি, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য ভারতের বাঘমারার তুরায় প্রথমে ২৮ দিনের রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। এরপর উনার শিক্ষাগত যোগ্যতা জেনে ফের শিলং পাঠিয়ে ওয়ারল্যাস চালানার জন্য আরো ১ মাসের ট্রেনিং করানো হয়। শিলং এ আরো অতিরিক্ত ৭দিন ওয়ারল্যাস চালনায় বিশেষ ট্রেনিং শেষে তিনি ৫নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাব সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন।
তিনি আরো বলেন, মাতৃভুমিকে পাকসেনামুক্ত করে যুদ্ধ জয়ের পরই আমরা বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হই, তখন আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ও সহযোদ্ধাদের ভুমিকার কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই বলতেন, টেকেরঘাট সাব সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ খুব একটা সহজ ছিলনা, এটি ছিল মুলত গেরিলা যুদ্ধ, রাস্তাঘাট বিহিন নৌ পথ, বড় বড় হাওরের বুকে নৌকায় করে পাক সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে প্রায়ই সম্মুখযুদ্ধে যেতে হত রাইফেল কাঁধে সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।
কান্নাজুরে দিয়ে তিনি আরো বলেন, দু’বছর ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যাবার পর চিকিৎসকরা বলেছেন উনার বেঁেচ থাকার আশা খুবই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। বাড়িতে থাকা অবস্থায় গত বুধবার উনি খুববেশী অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা জয়রামকুড়া হাসপাতালে নিয়ে এসে ডা. তাপস রেমাও ডা. লসি দারিং’র তত্বাবধানে ভর্তি করাই। পুরোপুরী শয্যাশায়ী হবার বছর খানেক পূর্বে প্রশান্ত সরকার স্ত্রী ও পরিবারের লোকজনকে জানিয়েছিলেন নিজের সহকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের সাথে বিজয় দিবসের দিনে একাওরের সাব সেক্টরের স্মৃতি বিজরিত মুক্তিযোদ্ধাগণের তীর্থভুমি ট্যাকেরঘাটে অনন্ত আরো একবার মিলিত হবার অতৃপ্ত আকাস্খার কথামালা।
পারিবারীক সুত্র জানায়, শিক্ষা জীবনে বিএ পাস করার পরপরই অবিবাহিত অবস্থায় ২৭ বছর বয়সে মাতৃভুমিকে পাক বাহিনীর কবল হতে রক্ষায় প্রশান্ত সরকার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে প্রদত্ত ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রামাণ্য তালিকার এ বীরযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলা হতে রাষ্ট্রীয় ভাতাদীর সুবিধা পেয়ে আসছেন মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের পর এ বীর যোদ্ধা ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার ধাইরপাড়ার প্রসান্না কুমার রেমা-অরুণাবালা রেমার জেষ্ট মেয়ে শীলাবতি রেমার সাথে বৈবাহিকজীবন শুরু করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
স্ত্রী শীলাবতী পেশায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ও এ দম্পতির তিন মেয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন শেষে জেষ্ট্য মেয়ে চিকিৎসক, মেঝো মেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্্সালটেন্ট ও কনিষ্ট মেয়ে সাংবাদিকতায় মাষ্টার্স সম্পন্ন করার পর অষ্ট্রেলিয়া হতে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত আছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বেশ কয়েকবছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করারপর ওয়ার্ল্ড ভিশন নামক একটি অর্গানাইজেশনে কর্মরত থেকে অবসরে যান। বাঙ্গালী খ্রীষ্ট্রান পরিবারে জন্ম নেয়া প্রশান্ত সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক (গারো) সমাজের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।তিনি গারো ব্যাপ্টিষ্ট কনভেনশন’র সেন্ট্রাল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দুবার নির্বাচিত হন। পাশাপাশি বিসি-ও জেনারেল সেক্রেটারী হিসাবে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করেন।
বিগত দু’বছর ধরে একাওরের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা প্রশান্ত সরকার দুরারোগ্য মরণব্যাধি ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। বুধবার মেঝো মেয়ে জেনিথ মৌসুমী সরকার গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীর নিকট শয্যাশাযী মুক্তিযোদ্ধা পিতা প্রশান্ত সরকারের জন্য দোয়া চেয়ে বললেন, আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বর্তমান সরকার প্রধান জাতীর জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতৃক যে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়েছেন তাতেই আমাদের পরিবার পরিজন চিরকৃতজ্ঞ।
ট্যাকেরঘাট সাব সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কোম্পানী কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাহিদ উদ্দিন আহমদ সহযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, ৫নং সেক্টরে মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ট্যাকেরঘাটে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন প্রশান্ত সরকার।
তিনি আরো বলেন, সাব সেক্টরে থাকা অবস্থায় প্রশান্ত সরকার ওয়ারল্যাস কমিউনিকেশনের কোডিং/ডিকোডিং কাজটি যুদ্ধকালীন সময়ে বেশ সফলতার সাথে করে যাবার পাশাপাশী সময়ে সময়ে হাওর নৌ পথে নৌকায় করে সরাসরি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন।