দুর্গাপুর(প্রতিনিধি)প্রতিনিধি : জাতিগত সংস্কৃতি ধারণ, লালন ও চর্চার মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা সম্ভব। বর্তমান সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। দুই দিনব্যাপী ‘‘গারোদের ঐতিহ্যবাহী ওয়ানগালা উৎসবে’’ প্রধান অতিথি হিসেবে আলোচনা সভায় এ কথা বলেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বুধবার বিকেলে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন নেত্রকোণা ১ আসনের সংসদ সদস্য মানু মজুমদার।
এ উপলক্ষে বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, মিলনায়তনে আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় অত্র একাডেমির সভাপতি ও নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক কাজী মোঃ আবদুর রহমান এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে মন্ত্রী খালিদ বলেন, বর্তমান সরকার জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষার পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, পরিচর্যা, বিকাশ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বর্তমানে ৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে আরো ৩টি নতুন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান (ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, নওগাঁ ও দিনাজপুর) নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ জীবনমানের অনেক উন্নয়ন সাধিত করেছেন বিধায় সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
ওয়ানগালা নিয়ে অন্যদের মধ্যে আলোচনা করেন, ময়মনসিংহ ১ আসনের সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. বদরুল আরেফীন, নেত্রকোনা পুলিশ সুপার মোঃ আকবর আলী মুন্সী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাজীব-উল-আহসান, কবি মিঠুন রাকসাম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলাম লেখক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ।
এ নিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি এর পরিচালক গীতিকার সুজন হাজং জানান, ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। এদের বিশ্বাস, দেবতা মিসি সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদ্গম ও তার পরিপক্বতা ঘটায়। তাই ফসল গ্রহণের আগে তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় এ উৎসবে। একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলা হয়ে থাকে। এটি মান্দিদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
আদিবাসীদের বিশ্বাস, দেবতা সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদগম ও তার পরিপক্বতা ঘটায়। তাই ফসল গ্রহণের আগে তারা তার পূজা করে থাকে। উৎসবের নিয়মানুসারে ক্ষেতের কিছু অংশের (আ’সিরকার স্থান) ধান কাটা হয় সর্বশেষে, ধুপ উৎসর্গ করে। তারপর সেটি আঁটি বেঁধে আনন্দ ধ্বনি দিয়ে নিয়ে আসে বাড়িতে। আদি থেকে এমনটাই বিশ্বাস মান্দি আদিবাসীদের।
প্রথমে এরা মোরগ উৎসর্গ করে মিসি সালজং বা সূর্যদেবতার নামে। তারপর বাড়ি বাড়ি চলে নতুন ধানের চাল দিয়ে ‘চু’ বা মদ তৈরির প্রস্ততি। সংনি নকমা (গ্রামপ্রধান) সভা ডেকে ওয়ানগালার দিন ঠিক করে জানিয়ে দেন সবাইকে। শুরু হয় পূজার স্থান, বাড়িঘর, গোলাঘর মেরামত ও পরিষ্কার করে নেওয়া। পরিবারের জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক। উৎসবের জন্য সংগ্রহ করা হয় মোরগ ও ডুকুয়া পাখির পালক।
উৎসবের প্রথম দিনের নাম ‘রুগালা’। এ দিনটিতে শস্যের জননী ও ভান্ডার দেবী রক্ষিমে, গৃহদেবতা, সূর্যদেবতা প্রভৃতির উদ্দেশে মদসহ উৎসর্গ করা হয় নতুন ধানের ভাত, নতুন ফসলের ফলমূল, শাকসবজি ও পশুপাখি। ওইদিন নকমা (গ্রামপ্রধান) নিকটস্থ ঝরনা বা খাল বা নদী থেকে দুটি কাঁকড়া ধরে এনে একটি পাত্রে রাখেন। দুপুরের আগে একটি লাল বা সাদা মোরগ নিয়ে তিনি জুমক্ষেতে যান। সেখানে আ’সিরকা স্থানে সেটি সূর্যদেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করে পূজা-অর্চনা করেন। তারপর বাড়ি ফিরে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের দ্রব্যসামগ্রী সাজিয়ে নেন। কিভাবে? ঘরের মাঝখানে কলার পাতায় নতুন ধানের ভাত, আদা, নানা জাতের কচু, কুমড়া, সলংগা প্রভৃতি শাকসবজি, ফলমূল দুভাগ করে কেটে সাজিয়ে রাখা হয়। পাশেই কৃষি যন্ত্রপাতি দা, কুড়াল, কোদাল, নিড়ানি প্রভৃতি রেখে, কলা পাতায় ঢেকে তার ওপর দেওয়া হয় কয়েক মুষ্টি চাল। অন্যপাশে রাখা হয় বাদ্যযন্ত্র- দামা, দাদিক, ক্রাম, রাং, নাগরা, আদিল, কাক্ওয়া, খা’আর প্রভৃতি। চালের মটকায় (পাত্রে) সাদা সুতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় তিনটি তুলার পিন্ড। দুপুরের পরেই নকমার বাড়িতে প্রথম শুরু হয় ওয়ানগালা অনুষ্ঠান।
নকমা প্রথমেই চাল রাখার মটকায় ভান্ডার দেবী ও খাদ্যশস্যের জননী রক্ষিমের পূজা-অর্চনা করেন। তারপর একটি মুরগি উৎসর্গ করে তার রক্ত সুতায় বাঁধা তিনটি পিন্ডে মাখিয়ে মটকার গায়ে রক্ত ছিটান এবং ভেজা রক্তে মুরগির লোমগুলো লাগিয়ে দেন। এসময় নতুন মদও উৎসর্গ করা হয়। মান্দি বা গারোরা একে বলে ‘রংদিক’ বা ‘মিত্দে’।
গৃহদেবতার উদ্দেশে নকমা মদ ও পানীয় উৎসর্গ করে একইভাবে মুরগির রক্ত ও লোম লাগিয়ে দেন বাদ্যযন্ত্রগুলোতে। তারপর কলার পাতায় ঢেকে রাখা কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর মন্ত্র পড়ে মদ উৎসর্গ করে শুরু হয় ওয়ানগালার প্রধান পূজা-অর্চনা।
এসময় নকমা পেতে রাখা ভাত-তরকারি, ফলমূল, শাকসবজি প্রভৃতি সামনে রেখে মন্ত্র পড়ে সারা ঘরে ছিটিয়ে দেন নতুন ধানের চাল। তারপর ধরে আনা কাঁকড়া দুটির ওপর মদ ঢেলে একটিকে ছেড়ে দিয়ে, অন্যটিকে একটি বাঁশের কাঠিতে বিদ্ধ করে ওপরে রেখে ঘরের মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হয়। বিদ্ধ এই কাঁকড়াটিকেই সূর্যদেবের বিদায়কালের সহযাত্রী হিসেবে মনে করা হয়।
এরপর নকমা সূর্যদেবতাকে উদ্দেশ করে মন্ত্র পড়ে মদ উৎসর্গ করেন এবং পাশে রাখা মিল্লাম (তরবারি) ও স্পি (ঢাল) হাতে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করেন। সবাই এসময় বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাতে থাকে। রুগালার রাতে গারোরা নাচ-গান, আমোদ-প্রমোদ করে কাটায়। প্রত্যেক বাড়িতে তৈরি হয় পিঠা। যুবক-যুবতীরা খুশি মনে নেচে গেয়ে পরস্পরকে মদ পান করায়। এভাবে প্রতিটি বাড়িতেই ‘রুগালা’ সম্পন্ন করতে হয়।
ওয়ানগালার দ্বিতীয় দিনটিকে বলে ‘সাসাত সআ’। মানে ধুপ উৎসর্গ অনুষ্ঠান। ওইদিন নকমা তার সারা ঘরে নতুন চালের ভাত ছিটিয়ে দেন। এ ছিটানো ভাতগুলোই শিলাবৃষ্টির প্রতীক। তারপর তিনি সূর্যদেবতার নামে ধুপ উৎসর্গ করে সারা ঘরেই ধোঁয়া ভরিয়ে দেন। কালো ধোঁয়া ঘরের বাইরে চলে গেলে আগামী বছর মেঘ এভাবেই ভেসে এসে বৃষ্টি ঝরাবে বলে মান্দিদের বিশ্বাস।
উৎসবের তৃতীয় দিনটিকে বলে ‘ক্রাম গগাতা’। অর্থ নকমার ক্রাম নকমার ঘরে তোলা। ওইদিন সকাল থেকে প্রথমে নকমার ও পরে সবার বাড়িতেই সংক্ষিপ্ত আকারে পালন করা হয় রুগালা ও সাসাত স’আর আচারগুলো। সন্ধ্যার আগে বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে সবাই সমবেত হয় নকমার বাড়িতে। তিনি তখন সবাইকে শেষবারের মতো তা বাজাতে বলেন।
বাদ্যযন্ত্রের সুরে নকমা সূর্যদেবতা ও রক্ষিমের উদ্দেশে শেষ রুগালা ও সাসাত স’আ করে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তারপর তারা যেন সামনের বছর এভাবেই এসে আশীর্বাদ করেন পরম ভক্তির সঙ্গে সে আবেদন জানিয়ে তাদের বিদায় দেন। দামা, ক্রাম, রাং প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রগুলো তখন নকমার ঘরেই জমা রাখা হয়। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে মান্দি বা গরোদের ওয়ানগালা উৎসবের।
জুম চাষকেন্দ্রিক এ উৎসবটিই মান্দিদের আদি উৎসব। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় বদলে গেছে অনেক কিছু। ধর্মান্তরিত হয়ে এ আদিবাসীরা আজ হারিয়ে ফেলেছে তাদের বিশ্বাসের আদি রেওয়াজগুলো। কিন্তু তবুও ওয়ানগালা উৎসবেই ফুটে ওঠে মান্দি বা গারোদের ঐতিহ্য ও আদি সংস্কৃতিগুলো। আর ঐতিহ্য গুলোকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি।