দিগন্ত ডেক্স : কেউ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, কেউবা আবার উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বষের্র শিক্ষার্থী। বয়সের ভিন্নতা থাকলেও কর্মস্পৃহা আর সৃজনশীলতায় ওরা যেন এক ও অভিন্ন। আর তাইতো পড়ালেখার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছে। এরই মধ্যে তারা ‘গিফটি’ এবং ‘ডাকবন্ধু’ নামে অনলাইন ভিত্তিক পণ্য সরবরাহ ও সেবা প্রদানকারী দু’টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। অল্পদিনেই সফলতা আসায় ‘উড়াল’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেছে ওরা।
ক্ষুদে এসব উদ্যোক্তাদের প্রত্যেকেই জানিয়েছে পড়ালেখা শেষ করে তারা কেউ চাকরি করবে না বরং নিজেরাই অন্যদের চাকরি দেবে। তারা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে একটা শ্লোগানও ঠিক করেছে- Be you, your own Boss (আপনি হোন, আপনার নিজের মালিক)। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ১৩ জনের উদ্যোক্তা গ্রুপের মধ্যমণি বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র শাহরিয়ার সিয়াম ও বগুড়া জিলা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ্ আল ফাহিম। দু’জনেই বিতার্কিক।
সিয়ামও বগুড়া জিলা স্কুলের ছাত্র ছিল। তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনাটি হয় ২০১৯ সালের শুরুতে বগুড়া জিলা স্কুলের ডিবেট ক্লাবে। সেই পরিকল্পনার কথা জানাতে গিয়ে সিয়াম জানায়, যেসব ছাত্র বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা সবাই টিফিন পিরিয়ডে ২০১ নম্বর রুমে ডিবেট ক্লাবে মিলিত হতো। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় রেফারেন্স হিসেবে অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায় তারা নিজেরা একক বা যৌথ উদ্যোগে নিজেদেরকে সফল করে তুলেছেন। সিয়াম বলে, ‘পড়ালেখা শেষে আমরা প্রত্যেকেই যে ভাল চাকরি পাব তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সে কারণেই আমারা উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনা করি।’
সহযোগী ফাহিম জানায়, করোনাকালের শুরুতে লকডাউনের সময়ে তাদের অনেক বন্ধু এবং স্বজনদের জন্মদিন এসে যায়। অনেকের বাবা-মা’র বিবাহ বার্ষিকীও ছিল। কিন্তু কেউ ঘর ছেড়ে বের হতে পারছিল না এমনকি ছোট্ট একটি উপহার বিনিময় করাও সম্ভব হচ্ছিল না। এগুলো তাদের খুব ভাবিয়ে তোলে। এরপর লকডাউন উঠে গেলেও অনেকে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বের হতেন না।
ফাহিম বলে, সেই দুঃসময়কেই তারা বেছে নেয়। যেহেতু তারা মানুষকে তাদের প্রিয়জনদের জন্য উপহার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা কওে তাই সেই উদ্যোগের নাম রাখা হয়- ‘গিফটি’।
এরই মধ্যে অষ্টম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া আরও ১১জন ছেলে-মেয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অন্যরা হলো- গুলজাহান স্মরণী, আনিকা তাবাসসুম, এস এম মারুফ, আব্দুল্লাহ্ আল মুকিত, আল মাহবুব সিয়াম, মুশফিক তালুকদার নিলয়, নূর নাসিম, আহ্বাব সুজয়, মাহফুজ ইসলাম, রাহ্ রাতিন ও সুস্মিতা আলম। তাদের মধ্যে শাহরিয়ার সিয়াম ‘গিফটি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং আব্দুল্লাহ্ আল ফাহিম কো-ফাউন্ডার বা সহ প্রতিষ্ঠাতার দায়িত্ব পালন করছে।
তারা জানায়, তারা প্রথমে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে তাদের পরিকল্পনার কথা জানায়। ২১ আগস্ট থেকে ‘গিফটি’র কার্যক্রম শুরু হয়। গিফটিতে মোট ২২ ধরনের আইটেম রাখা হয়। সেগুলো হলোঃ বই, কেক, চকলেটের বক্স, পেপার ল্যাম্প, নানা ডিজাইনের ব্যাগ, দইয়ের সরা (এক ধরনের মাটির পাত্র), ক্যানভাস, ব্যাঙ্গচিত্র, চাবির রিং ও বিভিন্ন ধরনের পুতুল। তবে যদি কেউ প্রিয়জনকে তাঁর স্কেচ উপহার দিতে চান তাহলে তাদের গ্রুপের চিত্রশিল্পী বন্ধু সেই স্কেচও তৈরি করে দেন।
ফাহিম বলে, গ্রাহকের পছন্দের পণ্যটি আমরা আমাদের তৈরি বিশেষ ধরনের ব্যাগে ভরে সরবরাহ করি। যেগুলোর মূল্য ১০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে। বগুড়া শহর থেকে যারা অর্ডার করেন তাদেরকে আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসি। অন্য জেলায় কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়। গেল ৪ মাসে আমরা তিন শতাধিক অর্ডার সরবরাহ করেছি। বগুড়ার বাইরে ঢাকা, রাজশাহী, ময়নমনসিংহ এবং মুন্সিগঞ্জ থেকেও আমরা অর্ডার পেয়েছি।
প্রথম উদ্যোগ ‘গিফটি’র সফলতার পর তারা ‘ডাকবন্ধু’ নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেছে। এ সম্পর্কে শাহরিয়ার সিয়াম জানায়, অনেকে ঘরে বসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন এবং ফেসবুক পেজে তার প্রচার করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে গ্রাহকদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে পারেন না- এমন ব্যক্তিদের সহায়তার জন্যই ‘ডাকবন্ধু’ সেবা চালু করা হয়েছে। নির্ধারিত ডেলিভারি চার্জের বিনিময়ে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তার তৈরি পণ্য নিয়ে তারা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়।
সর্বশেষ উদ্যোগ ‘উড়াল’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উদ্যোক্তা দলের অন্যতম ফাহিম জানায়, এটিও এক ধরনের পণ্য সরবরাহ সেবা কার্যক্রম। এর মাধ্যমে বাজারে পাওয়া যায়- এমন সব পণ্য চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। সে বলে, ‘করোনাকালে এখন মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অর্ডারই বেশি পাচ্ছি। এর পাশাপাশি পোর্টেবল সোপ টিউব, মাইক্রোফাইবার হেয়ার টাওয়ায়েল, শীতকালীন টুপি, স্টেশনারী সামগ্রী এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ নারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রীর চাহিদাও বাড়ছে। মেয়েদের ব্যক্তিগত পণ্যগুলো আমাদের গ্রুপের মেয়ে বন্ধুরা চাহিদা অনুযায়ী পৌঁছে দেয়।’
তিনটি প্রতিষ্ঠান সফল উল্লেখ করে শাহরিয়ার সিয়াম বলে, ‘আমাদের সব কার্যক্রম চলে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে গিফট্রি কার্যক্রম শুরু করেছি। আর কোন টাকা বিনিয়োগ না করে আরও নতুন দু’টি উদ্যোগ গ্রহণের পর আমাদের পূঁজির পরিমাণ বেড়ে এখন ৫০ হাজার টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। আমরা যেভাবে সাড়া পাচ্ছি তাতে আশাকরি করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে আমাদের ব্যবসা আরও ভাল হবে।’
গিফটি’র ফেসবুক পেজে নিজের স্কেচ-এর অর্ডার করেছিলেন ঢাকার বাসিন্দা অনন্যা সাহা। নির্ধারিত সময়ে পেয়ে যাওয়ায় ‘গিফটি’-কে ধন্যবাদ তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘এত কম সময়ের মধ্যে এত পারফেক্ট স্কেচ রেডি করে নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য গিফটিকে ধন্যবাদ।’ ‘উড়াল’-এর মাধ্যমে মাস্ক কিনেছেন বগুড়ার সাংবাদিক মেহেরুন নেছা ইতি। তিনি বলেন, ‘ওদের ওখানে নকশা ও কাস্টমাইজড- এই দুই ধরনের মাস্ক পাওয়া যায়। আমি নকশা মাস্ক কিনেছি। যার মান অনেক ভাল এবং দামও তুলনামূলক কম।’
স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের এমন উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান মিলন বলেন, ‘পড়ালেখা ঠিক রেখে ওরা যা করছে তা সত্যিই অভাবনীয়। ওদের প্যাকিং প্রক্রিয়ায় এতটাই অভিনবত্ব রয়েছে যে, সাধারণ একটা গিফট আইটেমও অসাধারণ হয়ে ওঠে। যা সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করে। ওরা যেভাবে এগুচ্ছে তাতে এটি হলফ করে বলতে পারি ওরা বহুদূর এগিয়ে যাবে।’