সুলোচনা সাংমা, সাবেক কালচারাল অফিসার : বাংলাদেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ লাখের অধিক আদিবাসী বাস করে। তবে এ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ১৯৯১ সালের এক সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে মাত্র ২৭টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নৃতাত্তি¡ক অন্তর্ভুক্ত মানুষ বাস করে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ৪৪টি নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠীর উল্লেখ হয়েছে। প্রতিটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী। তাহারা মাতৃ ও পিতৃতান্ত্রিক প্রথা মেনে চলেন। বম, বেদিয়া, বাগদি, চাকমা, গারো, হাজং, খাসিয়া, খিয়াং, খুমি, খারিয়া, কোচ, কুলে, কর্মকার, ক্ষত্রিয় বর্মণ, কন্দ, কুসাই, মারমা, ম্রো, মণিপুরী, মাহতো, মুÐা, মালো, পাংখো, ওরাওঁ, তংচঙ্গ্যা, পাহাড়িয়া, পাহান, পাত্র, রাখাইন, রাজুয়ার, রাই, রাজবংশী, সাঁওতাল, ত্রিপুরা প্রমুখ। তাদের বসবাস চট্টগ্রাম, বগুড়া, দিনাজপুর, গাজীপুর, পটুয়াখালী, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার প্রভৃতি সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে।
সংস্কৃতি মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা। সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশের প্রতিটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আদিবাসীরা অতীতকাল বাংলা ভাষাভাষী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করছে। আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহের জাতিতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যময় করেছে। তবে ঔপনিবেশিক সময়ে রাজনৈতিকভাবে এদেশে অন্য সংস্কৃতির যে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে।
অধিকাংশ আদিবাসীদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। একটি জাতির ভাষা-সংস্কৃতি বিকাশসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য তার মাতৃভাষা চর্চা অপরিহার্য। পাহাড়ি আদিবাসীরা জুমচাষ করে। আবার সমতলের আদিবাসীরা জীবন ধারণ করে কৃষি কাজের মাধ্যমে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, ভাষা, ধর্ম, আচার, প্রথার পরিবর্তন ঘটছে। আদিবাসী নারীরা সৌন্দর্যপ্রিয়। বিভিন্ন উৎসবে অনুষ্ঠানে তারা পুষ্পভরণে সজ্জিত হয়। কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর মেয়েরা শিমুল, চম্পা, রক্তকরবী ফুল খোঁপায় গুঁজে রূপসজ্জা করে থাকে। তারা কানে দুল, নাকে নথ ও মাকড়ি, সিঁথেয় সিঁথিপাটি, হাতে বালা, চুড়ি, বটফল, বাহুতে বাজু পরে থাকে।
বারো মাসে তের পার্বণের দেশ বাংলাদেশ। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার সমন্বয়ে মানুষের জীবন। তারা জন্ম-মৃত্যু, বিবাহকেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে বেশ জাঁকজমকভাবে। সাঁওতাল সমাজে ফাল্গুন মাস থেকে তাদের বছর গণনা শুরু হয়। তাদের উল্লেখযোগ্য পূজা-পার্বণের মধ্যে ফাল্গুন মাসে বাহা উৎসব, চৈত্র মাসে বোঙ্গাবুঙ্গি উৎসব, বৈশাখ মাসে হোম, জ্যৈষ্ঠ মাসে এরোরা সার্দার, আষাঢ় মাসে হাড়িয়াও, ভাদ্র মাসে ছাড়া, আশ্বিন মাসে দিবি, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে নওয়াই এবং পৌষ মাসে সোহরাই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সোহরাই সাঁওতালদের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববৃহৎ উৎসব। ওরাওঁ সমাজের পার্বণিক উৎসব মূলত ছয়টি। যথা : ক. সারহুল, খ. কারাম, গ. পশু উৎসব, ঘ. খারিয়ানি, ঙ. ফাগুয়া এবং চ. সোহরাই। কারাম ওরাওঁদের সবচেয়ে বড় উৎসব। ভাদ্র মাসে সাধারণত এ উৎসব পালন করা হয়। ওরাওঁরা মনে করে কারাম অর্থ বৃক্ষ রক্ষাকর্তা। বিজু ও সার্দারের ‘পানাহ’ হলো চাকমাদের প্রধান উৎসব এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের আদিবাসীদের (গারো) প্রধান উৎসব ওয়ান গালা, ১০০ ড্রাম্স সহ নানা ঐতিহ্যমুলক অনুষ্ঠান। এ সময় সব বয়সী নর-নারী উল্লাসে মেতে ওঠেন। আদিবাসী পাড়া মহল্লা গুলোতে বয়ে চলে উৎসবের বন্যা।
ত্রিপুরারা ভীষণ আনন্দপ্রিয়। তারা সারা বছর আনন্দ ফুর্তি করতে ভালোবাসে। তারা মনে করে আনন্দের কোনো মৃত্যু নেই। তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘বিষু উৎসব’। চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রায় মাসব্যাপী এই অনুষ্ঠান পাড়ায় পাড়ায় চলতে থাকে। এ সময় তারা ‘গরেয়া’ নৃত্যগীতির আয়োজন করে। শিবগৌরীর প্রেমলীলাকে এই নৃত্যে ফুটিয়ে তোলা হয়। তাদের উৎসবাদি এত প্রাণবন্ত হয় যে, তারা গান-নাচ-বাজনার মাঝে হারিয়ে যায়। চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ধর্মের প্রতি তাদের রয়েছে অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। তাদের প্রার্থনা ঘরের নাম ‘কেয়াং ঘর’। সব বয়সের নারী-পুরুষ সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করে। তারা সারা বছর বিভিন্ন উৎসব ও আনন্দানুষ্ঠানে মেতে ওঠে। তারা বাংলার বিভিন্ন মাসে ও পূর্ণিমার সঙ্গে মিলিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেমন আষাঢ়ী-পূর্ণিমা, বৌদ্ধ-পূর্ণিমা প্রভৃতি। তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব বিজু উৎসব বা সাংগ্রাইন উৎসব এবং বৌদ্ধ-পূর্ণিমা উৎসব। এ সময় তারা দিনব্যাপী নেচে-গেয়ে আনন্দ-উৎসব পালন করে। তাদের উৎসবগুলোতে বাড়িতে তৈরি পানীয় পান করে।
মণিপুরী নৃত্যের প্রকাশভঙ্গি নানা ধরনের, এই যেমন করতালি নৃত্য, মঞ্জিরা নৃত্য, অধিবাস নৃত্য, মৃদঙ্গ নৃত্য ইত্যাদি। এসব নৃত্যে পারদর্শী হতে গেলে অন্ততঃপক্ষে ৪০টি প্রাথমিক নৃত্যছন্দ জানতে হয়। এগুলো প্রথমে দাদরা তালে, পরে ত্রিতাল, তেওরা, ঝাঁপতাল, আদি চৌতাল, পঞ্চম্বরী, ল²ী-বিষ্ণু ও ব্রহ্মতালের লয়ে শিখতে হয়। এই নৃত্যশিল্পে পঞ্চাশেরও বেশি নাচের প্রচলন আছে। এর মধ্যে ‘মুখাবলি’ নৃত্য খুবই উপভোগ্য। মুখাবলি নৃত্যে হাত, পা, মুখ ও মাথায় যুগপৎ ছন্দিত সঞ্চালনে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রমণীর মনে কী ধরনের নাচের ইচ্ছা জাগে তাই যেন ফুটে ওঠে। তবে সব সেরা নৃত্য ‘লাই হারা উবা’। এসব নাচ শেখার জন্য রয়েছে বিশেষ মন্দির বা নাচঘর। সা¤প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
প্রতিটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ও আত্মপ্রকাশের মাধ্যমেই প্রত্যেক জাতির গৌরবময় রূপ ফুটে ওঠে। ঈঁষঃঁৎব শব্দটি ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম ব্যবহার করেন ফ্রান্সিস বেকন ষোল শতকের শেষ দিকে। সংস্কৃতি সনাক্তকরণের কোনো নির্দিষ্ট মানদ-, বৈশিষ্ট্য ও গন্ডি নেই। সমাজতত্ত¡বিদ ঔড়হবং বলেন, “মানুষ যা সৃষ্টি করে তার সামগ্রিক রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি।” নৃবিজ্ঞানী ঊ.ই.ঞুষড়ৎ বলেন, “সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি-প্রথা, আইন ইত্যাদির জটিল সমাবেশই হলো সংস্কৃতি।” বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। বহিঃর্জগতের সাথে তাদের সম্পর্ক খুবই কম।
বর্তমান সরকারের আমলে দেশের নানা উন্নয়ন সহ সংস্কৃতি রক্ষায় দেশ অনেক দুর এগিয়েছে সত্যি কিন্তু আদিবাসী সাংস্কৃতিক ঐহিত্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোন উদ্দ্যেগ নেয়া হয়নি এখনো। প্রতি বছর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয় থেকে শিল্পী সম্মাননা বাবদ যে আর্থিক সহায়তা করা হয়, সেখানে আদিবাসী শিল্পীদের সংখ্যা অতি নগন্য। আমি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের কৃতিসন্ত্রান সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের মাননীয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী জনাব কে এম খালিদ বাবু মহোদয়ের প্রতি বিনীত অনুরোধ রাখছি এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার জন্য। সেই সাথে দেশের মহানমুক্তিযুদ্ধ সহ দেশের নানা আন্দোলনে আদিবাসীদের সব সময়ই অংশগ্রহন রয়েছে। কাজেই এ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা ও তাঁদের নান্দনিক সংস্কৃতি রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানাই। (চলবে)